শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সামাজিক নিরাপত্তায় ইসলামি অর্থব্যবস্থা

মুফতি এনায়েতুল্লাহ :

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত আট লাখ মুসলিম জনসংখ্যার আর্থিক লেনদেন স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে দেশটিতে চালু হতে যাচ্ছে ইসলামি ব্যাংক। ইতিমধ্যে বিশেষ বিবেচনায় প্রথমবারের মতো সীমিত লাইসেন্স পেয়েছে ব্যাংকটি। আগামী দুই বছর সীমিতসংখ্যক (আট হাজার) গ্রাহকের মধ্যে পরীক্ষামূলক লেনদেন কার্যক্রম চালানোর পর পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবে ব্যাংকটি। কর্র্তৃপক্ষের আশা, ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মেইল সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

ইসলামি অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় অর্থব্যবস্থা। মুসলিম দেশের পাশাপাশি পৃথিবীর অনেক অমুসলিম দেশে ইসলামি ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু আছে। এ অর্থনীতি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তায় ভরা। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অন্যতম প্রধান বিষয়। এ জন্য ইসলাম তিন ধাপে দায়িত্ব বণ্টন করে। প্রাথমিক ধাপে ব্যক্তি নিজে তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, দ্বিতীয়ত সামাজিক পদক্ষেপের আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও তৃতীয় ধাপে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

সামাজিক নিরাপত্তায় অর্থনৈতিক মাধ্যম হিসেবে প্রথমে বাধ্যতামূলক দান হিসেবে জাকাতের বিষয়টি আসে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ সুরা তওবা : ৬০

এই আয়াতে বর্ণিত জাকাত খরচের খাতগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব খাতের সিংহভাগ খাতে দুর্বলতার কারণে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। আবার সেসব খাত স্থিতিশীল থাকলে সামাজিক নিরাপত্তা অনেকাংশেই স্থিতিশীল থাকে। বিশেষ করে জাকাতের উৎপাদনশীল ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পরিপূর্ণভাবে সামগ্রিক অভাব দূর করে তাদের যথাযথ পুনর্বাসন করা সম্ভব। একটি সর্বনিম্ন হারের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা যায়, শুধু বাংলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ৫,২৫০ কোটি টাকার জাকাত আহরণ হতে পারে, যা দিয়ে মাত্র কয়েক বছরেই দেশ থেকে আগ্রাসী দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।

ইসলামি অর্থনীতির ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে বায়তুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার)। কোনো কারণে জাকাত ও সামাজিক সহযোগিতার মাধ্যমে যদি দারিদ্র্যের পরিপূর্ণ বিলুপ্তি না ঘটে, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্য পরিস্থিতির আলোকে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে আধুনিক অর্থব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, ইসলামি ব্যাংকিং ও বীমা ব্যবস্থাপনার ব্যাপক সম্প্রসারণ অপরিহার্য।

অন্যদিকে ওশর (ফল ও ফসলের জাকাত) বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। ইসলামি অর্থব্যবস্থায় ফসলের জাকাত ফরজ হলেও বাংলাদেশের মতো ওশর আদায়ে সম্ভাবনাময় দেশে এর আদায়ের গুরুত্ব, প্রশিক্ষণ, জ্ঞান কিংবা সচেতনতা কোনো কিছুই না থাকার কারণে অর্থনীতির বিশাল একটি ক্ষেত্র থেকে দেশ ও দরিদ্র মানুষেরা বঞ্চিত হচ্ছে। ওশরের যথাযথ আদায় ও যুগোপযোগী ব্যবহার করতে পারলে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এ খাত ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। ওশরের সর্বনিম্ন হার যথা ৫ শতাংশ ধরেও যদি ওশর আহরণ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশে একেকটি ফসল মৌমুমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ওশর আহরণ সম্ভব, যদিও ১০ শতাংশ হার হিসাব করলে এর পরিমাণ আরও অনেক গুণ বাড়বে। ওশরের পাশাপাশি খারাজও (কৃষি জমির ওপর ভূমি কর) দারিদ্র্য বিমোচনে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।

ইসলামি অর্থনীতিতে ঐচ্ছিক দান হিসেবে ওয়াকফের ভূমিকা যুগ যুগ থেকে প্রমাণিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ খাতের মাধ্যমে পর্যটন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও এতিম লালন-পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মূলধারার অর্থনীতির জোগানদাতার ভূমিকা পালন করত। বাংলাদেশে একসময় ওয়াকফের চর্চা থাকলেও নতুন করে উল্লেখযোগ্য হারে ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান বাড়ছে না। অন্যদিকে ওয়াকফ সম্পত্তি যা রয়েছে, তা দখল হয়ে গেছে কিংবা যথাযথভাবে সেসব ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে অনেক স্বাবলম্বী মানুষ আছে যারা বিলিয়নোর্ধ্ব টাকার পরিমাণ সম্পদের মালিক। তাদের মাধ্যমে দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে অকল্পনীয় হারে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন হওয়া একেবারেই সম্ভাব্য একটি বিষয়। ব্যক্তিগত ও সরকারি তত্ত্বাবধানে পর্যটন সুবিধা গড়ে তোলা, অসহায়দের জন্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, নানামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বয়স্ক নিবাস ও বিধবা পুনর্বাসনসহ ওয়াকফের মাধ্যমে বহুমাত্রিক পদক্ষেপের সমন্বয়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করা যায়।

আশার কথা হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের আলোকে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা আশা জাগানিয়া অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সুদভিত্তিক লেনদেনের এত বেশি প্রচলন ছিল যে একসময় বাংলাদেশের জনগণ সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা আছে তা কল্পনাও করতে পারত না। আশির দশকের আগ পর্যন্ত যারা ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকার করত না, ধীরে ধীরে তাদের মন ও মননে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করল, তারা তাদের বদ্ধমূল ধারণা থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে ইসলামি অর্থব্যবস্থার দৃশ্যমান সফলতা অবলোকন করার পর তা স্বীকার করা শুরু করে। পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্ব ও বিভিন্ন অমুসলিম রাষ্ট্র ইসলামি অর্থনীতিকে স্বীকার করে তার প্রসারে ভূমিকা রাখা শুরু করল, ফলে বহু অমুসলিম দেশে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার জনপ্রিয় প্রচলন লক্ষ করা যায়।

বাণিজ্যিক অর্থায়ন, শিল্প অর্থায়ন, গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পসহ বহুমুখী বিনিয়োগ সফলতা ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থার নানাবিধ পরিভাষার সঙ্গে অভিজাত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকরা পরিচিত হচ্ছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। এভাবে ইসলামি অর্থব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কার্যকর করা গেলে, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, সেই সঙ্গে মানুষের জীবনমানে ঘটবে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন।

লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION